সুরা ফাতেহার মর্যাদা

ইসলামিক ডেস্কঃ সুরা ফাতেহা কোরআনে কারিমের সবচেয়ে ফজিলতময় ও গুরুত্বপূর্ণ সুরা। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তপ্রাপ্তির শুরুর দিকে সুরা ফাতেহা অবতীর্ণ হয়। যদিও এই সুরা অবতীর্ণ হওয়ার আগে সুরা ইকরা, মুজজাম্মিল ও মুদ্দাসসিরের কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ সুরা হিসেবে সুরা ফাতেহাই সর্বপ্রথম একত্রে নাজিল হয়। সুরা ফাতেহার আয়াত সংখ্যা সাতটি। শব্দ সংখ্যা সাতাশটি। সুরা ফাতেহা মর্মার্থের গভীরতার দিক দিয়ে যতটা ভারী পাঠ করার দিক থেকে ঠিক ততটাই সহজ ও সাবলীল। সুরা ফাতেহার আয়াতগুলো ছোট ছোট। শব্দগুলো উচ্চারণে সহজ। তাই কেউ শেখার একটু চেষ্টা করলেই শুদ্ধ ও সাবলীলভাবে পাঠ করতে পারে।

ফাতেহা অর্থ সূচনাকারী। কোরআনে কারিমের সূচনাতেই এই সুরার অবস্থান। তাই এই সুরাকে ফাতেহা বলা হয়। ফাতেহা ছাড়াও এই সুরার আরও বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে। যেমন উম্মুল কোরআন, উম্মুন অর্থ মা। সুরা ফাতেহা কোরআনের মৌলিক বিষয়াবলিকে সংক্ষিপ্তভাবে শামিল রাখে। যেমনিভাবে সন্তান মায়ের গর্ভে লুকায়িত থাকে তেমনিভাবে এ সুরার মধ্যে পুরো কোরআন লুকায়িত। কোরআনের মৌলিক বিষয় তিনটি। এগুলো হলো আল্লাহতায়ালার প্রশংসা, তার আদেশ-নিষেধের আনুগত্য এবং আল্লাহ কর্র্তৃক পুরস্কারের অঙ্গীকার ও আজাবের ভয়ভীতি প্রদর্শন। এ বিষয়গুলো সুরা ফাতেহার মধ্যে সংক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়।

সুরাতুল কাফিয়া। কাফিয়া অর্থ যথেষ্টকারী। সুরা ফাতেহা পুরো কোরআনের নির্যাস। এই সুরার মধ্যে কোরআনের সব বিষয় সংক্ষিপ্তভাবে বিদ্যমান। কোরআনের যাবতীয় বিষয়াবলিকে বর্ণনা করতে এই সুরাটিই যথেষ্ট।

সুরাতুস সালাত। সালাত অর্থ নামাজ। সুরা ফাতেহার অন্যতম দুটি বিশেষত্ব হলো এর দ্বারা কোরআনের সূচনা করা হয়েছে এবং নামাজের সূচনাতেও সুরা ফাতেহা পাঠ করা হয়। সুরা ফাতেহা পাঠ না করলে নামাজ হয় না। তাই সুরা ফাতেহাই যেন নামাজ তথা সালাত। নামাজ বিশুদ্ধ হওয়া নির্ভর করে সুরা ফাতেহার শুদ্ধতার ওপর। তাই সুরা ফাতেহা নামাজে পাঠ করা ওয়াজিব হলেও নামাজের জন্য তা শিক্ষা করা ফরজ।

সুরাতুদ দোয়া। দোয়া অর্থ প্রার্থনা করা। এই সুরার মাঝে দোয়া ও প্রার্থনা রয়েছে। দোয়া ও প্রার্থনার পদ্ধতিও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেমন প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করবে তারপর তার কাছে প্রার্থনা করবে। প্রার্থনার আগে এই সুরা পাঠ করলে প্রার্থনা কবুল হয় এমন বর্ণনাও রয়েছে।

সুরাতুশ শিফা। শিফা অর্থ নিরাময়। সুরা ফাতেহা সব রোগের নিরাময়স্বরূপ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সুরায়ে ফাতেহা সব রোগের ওষুধ। তিরমিজি

ইবনে কাইয়িম কর্র্তৃক রচিত জাদুল মাআদ গ্রন্থে সুরা ফাতেহাকে পরিপূর্ণ শিফা, উপকারী ওষুধ এবং দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, ভয় ও হতাশা দূরকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার অন্য গ্রন্থ মিদরাজুস সালিকাইনে সুরা ফাতেহাকে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার অসুখের নিরাময় বলা হয়েছে। তবে এর জন্য শর্ত রয়েছে। সুরা বনি ইসরাইলের ৮২ নম্বর আয়াতের সার কথা হলো এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার জন্য পরিপূর্ণ মুমিন হওয়া শর্ত। মুমিন না হলে এর দ্বারা উপকৃত হওয়া যাবে না। বরং ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে।

সাবউল মাছানি। সাবউন অর্থ সাত। মাছানি অর্থ বারবার। সাবউন বলা হয় সুরাটি সাত আয়াতের হওয়ায়। আর মাছানি বলার কারণ হলো এই সুরাটি নামাজে বারবার পাঠ করা হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজে সুরা ফাতেহা পাঠ করা হয় সতেরোবার, সুন্নত নামাজে বারোবার এবং ওয়াজিব নামাজে তিনবার। এভাবে একজন নামাজি দৈনিক মোট বত্রিশবার সুরা ফাতেহা পাঠ করে থাকেন। তাই একজন মুসলমান নামাজি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে সুরা ফাতেহার গুরুত্ব অনেক বেশি।

সুরা ফাতেহার ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে বিশুদ্ধ হাদিসে অনেক বর্ণনা রয়েছে। সুরা ফাতেহাকে কোরআনের শ্রেষ্ঠ সুরা এবং বিশেষ নূর হিসেবে অবিহিত করা হয়েছে। হজরত আবু সাঈদ ইবনে মুয়াল্লা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক দিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, আমি কি মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে তোমাকে কোরআনের শ্রেষ্ঠতর সুরাটি শিক্ষা দেব না? অতঃপর ইবনে মুয়াল্লা (রা.) যখন মসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছাপোষণ করলেন তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি তো আমাকে কোরআনের শ্রেষ্ঠতর সুরাটি শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তা হলো সুরা ফাতেহা। এটিই বারবার পঠিত হওয়া সেই সাতটি আয়াত এবং আমাকে প্রদত্ত মহা কোরআন। সহিহ বোখারি

অন্য এক হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হজরত জিবরাইল (আ.) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বসা অবস্থায় ওপর দিক থেকে একটি দরজা খোলার আওয়াজ শোনেন এবং ওপর দিকে মাথা উঠিয়ে বলেন, আকাশের এ দরজাটি এর আগে কখনোই খোলা হয়নি। তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ওই দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা নেমে আসতে দেখলাম। এরপর হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, এই ফেরেশতা জমিনে এর আগে আর কখনো নামেনি। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ওই ফেরেশতা আমাকে বলল, আপনি দুটি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, যা আপনাকে প্রদান করা হয়েছে। যা আপনার আগে কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। তা হলো সুরা ফাতেহা এবং সুরা বাকারার শেষাংশ। সহিহ মুসলিম

কোরআনের তিনটি মৌলিক বিষয়ের একটি হলো আল্লাহর একত্ববাদ। সুরা ইখলাসে আল্লাহর একত্ববাদ সাব্যস্ত হয়েছে। তাই এই ছোট সুরাটি মর্মার্থ প্রকাশের দিক থেকে সম্পূর্ণ কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান। আর সুরা ফাতেহা হলো সম্পূর্ণ কোরআনের সার-সংক্ষেপ। কোরআনের তিনটি মৌলিক বিষয়কেই পাওয়া যায় সুরা ফাতেহায়। কোরআন-হাদিসে সুরা ফাতেহাকে বলা হয়েছে মহা কোরআন। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপন, নিয়ামতপ্রাপ্ত হওয়া এবং ভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার অনন্য প্রার্থনা হলো সুরা ফাতেহা। এই কারণে সুরা ফাতেহার মর্যাদা অন্যান্য সুরার তুলনায় বেশি এবং একজন মুসলমান নামাজি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে সুরা ফাতেহা সবচেয়ে বেশি পঠিত হওয়ায় এই সুরার গুরুত্ব অপরিসীম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *