যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো নৈতিক শিক্ষা। আর এগুলো রপ্ত করতে হয় প্রথমত পরিবার থেকেই। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়। উন্নত ডিগ্রি হাসিলের সার্টিফিকেট লাভ করা যায়। মেধাবী হওয়া ও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কিংবা মার্জিত আচরণ সম্পর্কিত নয়। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায়, অনেক উচ্চশিক্ষিত অন্যের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, হতে পারে তিনি হয়তো ছোটবেলায় তার পরিবারের কাছ থেকে সামাজিক লোকাচারের শিক্ষা ভালোভাবে পাননি কিংবা তাকে দেওয়া হয়নি। আচার-আচরণে ভদ্রতা বজায় রেখে চলতে না পারলে, মানুষের সঙ্গে মার্জিত আচরণ না করলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যায়।
সন্তান জন্ম দেওয়া সহজ, কিন্তু তাদের মানুষ করা কঠিন। তাই সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক আচার-আচরণ শেখাতে হয়, সন্তানকে মাঝেমধ্যে কাছে কিংবা দূরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে হয়। ভ্রমণে শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। শহুরে জীবন ব্যবস্থায় অনেক পরিবারের দুই অভিভাবকই থাকেন কর্মস্থলে ব্যস্ত। ফলে তাদের কাছ থেকে যতটুকু সময় সন্তানের প্রাপ্য, তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। এর ফলে সন্তানদের বেশ লম্বা একটা সময় একা কিংবা কাজের লোকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়, এ সময় অনেক সন্তান টেলিভিশন দেখে, মোবাইলে গেম খেলে কিংবা অন্য কোনোভাবে শিশু সময় কাটায়। অনেক সময়ে একাকীত্বের কারণে এ সময় তাদের মস্তিষ্কে ভর করে উদ্ভট-কিংবা নানাবিধ চিন্তা। সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের এমন সম্পর্কহীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই সম্পর্কহীনতার দরুন সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন, সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা, পরিবারের অন্য সদস্যদের ঠকিয়ে পিতা-মাতার সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নেওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এসব ঘটনা কাছাকাছি সময়ে খুব একটা ঘটত না, কিন্তু এখন হরহামেশাই ঘটছে। এর পরিবর্তন দরকার।
আধুনিকতায় ছোঁয়া সন্তানের গায়ে লাগানো যাবে না, এমনটা নয়। তাকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় করে তুলতে হবে, কিন্তু স্রোতের সঙ্গে ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না। অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে তাকে নষ্ট হওয়া পথে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যথাসম্ভব সন্তানের আবদার পূরণ করতে হবে, কিন্তু অন্যায় দাবি মেনে নেওয়া যাবে না। সন্তানকে শেখাতে হবে, উত্তম আচরণ আর মন্দ আচরণের পার্থক্য। কোরআনে কারিমে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদের ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না এবং বলো তাদের শিষ্টাচারপূর্ণ কথা।’ সুরা বনি ইসরাইল: ২৩
বলতে দ্বিধা নেই, চলমান সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য প্রধানত দায়ী নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসনজনিত মূল্যবোধের অভাব। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে চরিত্রবান ও দায়িত্ববান করে তোলে। মানুষের মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত করে। তার মধ্যে খারাপ পথে যাওয়া ও চলার ব্যাপারে ভয়ভীতির সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে প্রযুক্তি আর অপসংস্কৃতির স্রোত আমাদের সন্তানদের ভালোমন্দ চেনাতে পারছে না। এছাড়া নৈতিক অবক্ষয়ের পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান, এর অন্যতম হলো পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষার অভাব। নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজপ্রাপ্যতা, অসৎ ও চরিত্রহীন বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য। সচেতনতার সঙ্গে যথাযথভাবে পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন না করা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সুশিক্ষাদানে উদাসীনতা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, অশ্লীলতা। সমাজ সেবামূলক কাজে কিশোর-কিশোরীদের উদ্বুদ্ধ না করা। পারিবারিকভাবে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা না করা এবং বেয়াদবিমূলক আচরণ করলে তা শুধরে না দেওয়া। এসব বিষয়ে বাবা-মাকে সতর্ক থাকতে হবে। পারিবারিক কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ জন্ম দেয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। সন্তানের মনে আঘাত লাগে, দাগ কাটে কিংবা সে লজ্জিত হয়, এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।