বিনোদন ডেস্কঃ সৃষ্টির নেশায় ডুবে থাকতেও কুমার বিশ্বজিৎ চান প্রকৃতির সান্নিধ্য। ইট-কাঠের শহরেও সবুজের হাতছানি এড়াতে পারেন না। ঘর-বারান্দা-ছাদ তাই সাজিয়ে রেখেছেন নানা প্রজাতির বৃক্ষসম্ভারে। প্রকৃতিপ্রেমী এই শিল্পীকে নিয়ে এবারের আয়োজন। লিখেছেন সাদিয়া মুনমুন
‘বংশ পরম্পরায় আমার মধ্যে জেগে উঠেছে প্রকৃতিপ্রেম। তাই ইট-কাঠের এই শহরে সবুজের সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমার বাবা, দাদাসহ বংশের অনেকের দুর্বলতা ছিল ফুল-ফলের বাগানের প্রতি। তাদের মতো আমিও যে প্রকৃতিঘেঁষা হয়ে উঠব- এটাই শুধু জানা ছিল না। আসলে আমি যা চেয়েছি, সেভাবে ঘর-গৃহস্থালি গোছানো নানা কারণেই এতদিন হয়ে ওঠেনি। তার পরও দেরিতে হলেও একটু একটু করে বাড়িয়ে যাচ্ছি সবুজের সংগ্রহ। বাসার ছাদ থেকে শুরু করে বারান্দা এমনকি ঘরও সাজিয়েছি নানা প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ দিয়ে। যার সবুজ আলোয় কাটানো সময়ে মন ভরে থাকে অন্যরকম এক ভালো লাগায়।’
প্রকৃতিপ্রেম আর বাগানবিলাস নিয়ে এভাবেই এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন নন্দিত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক কুমার বিশ্বজিৎ। প্রচারমাধ্যমগুলোর সুবাদে রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত তার সবুজে মোড়া বাড়িটি এরই মধ্যে অনেকের নজর কেড়েছে। তার কালজয়ী গান ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’-এর গীতিকথায় যেভাবে মনের মানুষকে সাজিয়ে-গুছিয়ে হৃদয়ে স্থান করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, অনেকটা সেভাবেই আপন নিবাসেও বিশ্বজিৎ রূপান্তর করেছেন নন্দনকাননে। আর এটা যেন আগে-পরে হওয়ার ছিলই। অন্তত বিশ্বজিৎ যা বললেন, তা থেকে এটাই স্পষ্ট, পূর্বপুরুষদের সবুজ-প্রীতি তার মনেও দারুণ প্রভাব ফেলেছে। তাই কয়েক বছর ধরে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে তিনি সংগ্রহ করে যাচ্ছেন নানা জাতের ফল ও ফুলের গাছ। যেগুলো স্থান পেয়েছে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে রাখা বাহারি টবে। ছাদবাগানের সিঁড়িতেও রেখেছেন সবুজ গালিচা। আর বারান্দার গ্রিলে ঝুলন্ত টবে রাখা হয়েছে অসংখ্য চারাগাছ, যার কোনো কোনোটি বর্ণিল ফুলের শোভায় ছেয়ে আছে। একই সঙ্গে মৌসুমি ফলের সমাহারও চোখে পড়ছে তার বাগানে। সব মিলিয়ে করোনার এই ঘরবন্দি সময়টা কুমার বিশ্বজিতের কাটছে প্রকৃতির সবুজ ছায়ায়।
সবুজের প্রসঙ্গ থেকে এবার বাড়ির অন্যান্য সাজসজ্জার বিষয়ে জানতে চাইলে কুমার বিশ্বজিৎ এক কথায় জানিয়ে দিলেন, গাছের বাইরে অন্যান্য সাজসজ্জায় বড় ভূমিকা রেখেছেন তার স্ত্রী। চটকদার কিছু নয়, মানানসই আসবাব দিয়েই তার ঘর-গৃহস্থালি সাজানো হয়েছে। তার এ কথায় প্রমাণ মেলে বাড়ির চারপাশে চোখ রাখলে। আমরা অনেকেই জানি, কাজের বিষয়ে কুমার বিশ্বজিৎ অনেকের চেয়ে কিছুটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের। গানের মান নিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে তিনি নারাজ। সংগীত তার পেশা, নেশা এবং ধ্যানজ্ঞান। সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতেও রয়েছে বাড়ির দেয়ালের কিছু চিহ্ন। গিটার, ড্রামসের মতো কিছু বাদ্যযন্ত্রের অংশবিশেষ, সংগীতের স্টাফ নোটেশনে এবং শ্রবণ ইন্দ্রীয় ভাস্কর্যের আদলে তার বাড়ির দেয়ালে তুলে ধরা হয়েছে। আশপাশে রাখা নানা ধরনের শিলা আর বুনো গাছের সম্ভারে বোঝানো হয়েছে, সংগীত প্রকৃতিরই এক অনন্য উপাদান।
তাই প্রতিটি গান সৃষ্টিতে যেমন যত্নের ত্রুটি রাখেন না বিশ্বজিৎ, তেমনই প্রিয় বাগিচার জন্যও অবসর সময়ের অনেকটাই ব্যয় করেন। চিন্তিত থাকেন বিভিন্ন সময়। এই যেমন ক’দিন ধরে তার বাসার মালী আসছেন না, এখন গাছগুলোর পরিচর্যা হবে কীভাবে- এ নিয়ে খানিকটা চিন্তিত দেখাল তাকে। সে কথা স্বীকারও করলেন নন্দিত এই শিল্পী। বললেন, এ তো শুধু গাছ নয়, জীবন আর সৌন্দর্যের মিলিত স্পন্দন- অনন্ত আমি এভাবেই বলতে চাই। প্রকৃতি উজাড় করে আর যাই হোক সৃষ্টিতে প্রাণের স্পন্দন আনা যায় না। পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে প্রকৃতিকে রক্ষা করতেই হবে। এ জন্য আমি তাদের সাধুবাদ জানাই, যারা নানা সংকটের মাঝেও সীমিত পরিসরে হলেও সবুজ ছায়ার নিচে মানুষকে বসার জায়গা করে দিচ্ছেন। এ তো গেল একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের কথা। এবার আসি পাঁচ দশক ধরে সংগীতাঙ্গন মুখরিত করে রাখা নন্দিত শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের কথায়। এরই মধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন, ক’দিন আগে সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই বছর মেয়াদি কার্যকরী এ কমিটিতে কুমার বিশ্বজিৎ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। আর এই দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশের শিল্পী ও সংগীতাঙ্গনের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যদিও করোনা এবং লকডাউনের কারণে অনেক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে, তারপর করোনা সংকট কাটিয়ে ওঠার পর নতুন উদ্যমে কাজ করে যাবেন বলে জানিয়েছেন। সংগীতাঙ্গনের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি বলেন, ‘গান যাদের প্রাণ, প্রতিটি মুহূর্ত যাদের কাটে সৃষ্টি আর সংগীত পরিবেশনায়, তারাই এখন ঘরবন্দি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছেন না। স্টেজ শো নেই, টিভি লাইভও আগের মতো হচ্ছে না, যেজন্য অনেকের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। একদিন-দু’দিন নয়, প্রায় দুই বছর ধরেই মিউজিশিয়ানদের অবস্থা খারাপ। যারা প্রাণের তাগিদে মিউজিক করেন, তাদের দিন যে কীভাবে কাটছে, তা বলে বোঝানো কঠিন। একটা অদৃশ্য পরজীবীর কাছে আমরা এভাবে জিম্মি হয়ে পড়ব- তা সত্যিই ভাবিনি।
করোনার জন্য শুধু গানের ভুবন নয়, প্রতিটি অঙ্গনের মানুষকে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। অনেক গুণীও চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। সবদিক থেকেই ভয়াবহ এক সময় পাড়ি দিচ্ছি আমরা। তাই বিপর্যস্ত সময় পেরিয়ে সবকিছু নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে। সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সেই কাজেই সবার আগে মনোযোগ দেবে। কুমার বিশ্বজিতের এ কথা থেকে জানা গেল, আগামী দিনগুলোর পরিকল্পনা কথা। এবার আসা যাক নন্দিত এই শিল্পীর গানের নতুন আয়োজন প্রসঙ্গে। কয়েক প্রজন্ম যার গান শুনে বেড়ে উঠেছে এবং অর্ধশতাব্দী যার গানের সঙ্গে ওঠা-বসা, সেই শিল্পী ও সংগীতায়োজক এখন কী নিয়ে ব্যস্ত। নতুন গানের প্রসঙ্গ আসতেই কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘এবারের লকডাউন শুরুর আগেই এসএ হক অলিকের নতুন ছবিতে প্লেব্যাক করেছি। আরেকটি একক গানে কণ্ঠ দিয়েছি। গানটির সুরকার বেলাল খান। তার কয়দিন আগে গীতিকবি আসিফ ইকবালের লেখা দুটি গান রেকর্ড করেছি। এই গীতিকার জানিয়েছেন, তিনি ‘ঐশ্বর্য’ নামের একটি মিশ্র অ্যালবামের কাজ করছেন, যেখানে নতুন এই দুটি গান রাখা হবে। তার আগে রাজীবের কথা ও সুরের ‘মেঘদূত’ শিরোনামের একটি গান করেছি। এই গানগুলো গাওয়ার পর আলাদা এক ধরনের ভালো লাগায় মনটা ছেয়ে গেছে। আসলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে নতুন ধরনের কিছু কাজ করতে চেয়েছি, তরুণ সুরকারদের কাজগুলো সেই ইচ্ছা কিছুটা হলেও পূরণ করেছে।’
কুমার বিশ্বজিৎ প্রবীণ এবং নতুনদের সঙ্গে সমান্তরালে কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তার অনিন্দ্য সৃষ্টি এনে দিয়েছে খ্যাতি ও অগণিত মানুষের ভালোবাসা। তবুও অর্থ ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কখনও তিনি স্রোতের জোয়ারে গা ভাসাননি। শুরু থেকে এখনও এ বিষয়ে খুঁতখুঁতে স্বভাবের রয়ে গেছেন। এ নিয়ে তার কথা হলো, ‘এই খুঁতখুঁতে স্বভাব চিরকাল থেকেই যাবে। কারণ কিছু মানুষ থাকেন, যাদের কোনো কাজই শতভাগ মনের মতো হয় না। আমি তাদেরই একজন। যে কাজই করি, শেষ করার পর মনে হয়, এই জায়গাটা এমন না হয়ে এমন হতে পারত। এটা বদলানো যেত, ওটা আরেকটু আলাদা হতে পারত- এমন অনেক কিছুই মনে হয়। আসলে কোনো কাজ শেষ বলে ধরে নেওয়া হলেও পরে সেখানে অনেক কিছু অসমাপ্ত রয়ে গেছে বলেই মনে হয়। এটা তখনই পরিপূর্ণ মনে হবে, যখন প্রকৃতির মতো শিল্পীর সত্তার সবটুকু উজাড় করে না দিতে পারব।’
তথ্যসূত্র: সমকাল