আল্লাহতায়ালা তার অবারিত রহমতের প্রতি যেমন মুমিনদের আশান্বিত হতে বলেছেন, তেমনি তার পাকড়াওকে ভয় পেতে বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো ভয় ও আশার সমন্বয় কীভাবে হবে? প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, ভয় ও আশার ক্ষেত্রে মুমিন হবে ভারসাম্যপূর্ণ। মুমিন যেমন আল্লাহর রহমতে আশান্বিত হয়ে তার শাস্তির কথা ভুলে যাবে না, তেমন আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তার দয়া ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ে যাবে না। এ জন্য আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমের একাধিক আয়াতে শাস্তি ও পুরস্কারের কথা পাশাপাশি এনেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক দ্রুত প্রতিশোধ গ্রহণকারী, তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ সুরা আরাফ : ১৬৭
বর্ণিত হাদিসের আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, মুমিন শুধু পরকালীন জীবনের ব্যাপারে নয়; বরং পার্থিব জীবনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির ব্যাপারেও সে ভয় ও আশা পোষণ করবে। কেননা পরকালীন কল্যাণ ও অকল্যাণ আল্লাহর হাতে। তবে কোনোভাবেই শুধু দুনিয়ার আশা, পার্থিব বিষয়ে দীর্ঘ কোনো আশা করবে না।
দীর্ঘমেয়াদী আকাক্সক্ষা মানুষের জন্য অনেক বড় দুর্ভাগ্যের কারণ। এটা শয়তানের ধোঁকা। শয়তান মানুষকে বলে, আরে বোকা! সামনে তো অনেক সময় আছে। এই সময়টা ভোগ করতে হবে এবং বড় বড় আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হবে। শয়তানের এই কুমন্ত্রণায় প্রতারিত হয়ে মানুষ তার সব মনোযোগ দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের পেছনে ব্যয় করে। বড় বড় স্বপ্ন দেখতে থাকে এবং সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে থাকে। এভাবে সে আখেরাতের কথা ভুলে যায়। মৃত্যুর কথাও ভাবতে চায় না। এ কারণে দুনিয়ায় ভোগ-বিলাসের লম্বা লম্বা স্বপ্ন দেখতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমি তোমাদের সম্পর্কে সবচেয়ে ক্ষতিকর যে বিষয়ের আশঙ্কা করি তা হচ্ছে দুটি ১. প্রবৃত্তির অনুসরণ ও ২. দীর্ঘ আশা। কারণ প্রবৃত্তির অনুসরণ সত্য থেকে বিচ্যুত করে, আর দীর্ঘ আশা, এটাই তো হলো দুনিয়ার মোহ।
সুতরাং মানুষ যখন দুনিয়াকে বেশি ভালোবাসে তখন দুনিয়াকে আখেরাতের ওপর প্রাধান্য দেয় এবং আখেরাতে নবী, সিদ্দিক (সত্যবাদী), শুহাদা (শহীদ) ও সালেহিনের (সৎকর্মশীল) সঙ্গে আল্লাহর সান্নিধ্যে জান্নাতে থাকার চেয়ে দুনিয়ার চাকচিক্য ও ভোগ-বিলাসকেই উত্তম মনে করে।
পক্ষান্তরে দুনিয়ার আশা-আকাক্সক্ষা যখন কম হয় এবং আখেরাতের চিন্তা যখন অন্তরে থাকে তখন মানুষ নেক আমলের দিকে অগ্রসর হয় এবং জীবনের মূল্যবান সময়কে কাজে লাগায়। জীবনের সময় খুব অল্প। আর যে সময়টুকু চলে যায়, তা কখনো ফিরে আসে না। অন্যদিকে আখেরাতের পথে আছে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে সাবধান করেছেন উম্মতকে।
এক হাদিসে ইরশাদ করেছেন, তোমরা সাতটি অবস্থা আসার আগেই আমল করে নাও। তোমরা কি শুধু অপেক্ষায় আছ ওই দারিদ্র্যের, যাকে তোমরা ভুলে গেছ কিংবা ওই ধনাঢ্যতার, যা মানুষকে বেপরোয়া করে দেয়, কিংবা ওই অসুস্থতার, যা মানুষকে অক্ষম করে দেয় কিংবা ওই বার্ধক্যের, যা মানুষকে বুদ্ধিহীন করে ফেলে কিংবা ওই মৃত্যুর, যা দ্রুত এগিয়ে আসছে, কিংবা দাজ্জালের, সে তো প্রতীক্ষার সব বস্তুর মধ্যে সর্ব নিকৃষ্ট, কিংবা অপেক্ষা করছ কিয়ামতের, কিয়ামত তো আরও ভয়াবহ ও ভীতিময়! জামে তিরমিজি : ২৪০৮
হাদিসে আরও বলা হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাঁধ ধরলেন এবং বললেন, তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো, যেন একজন ভিনদেশি বা পথিক।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা করো না। আর সকালে করো না সন্ধ্যার অপেক্ষা। তুমি সুস্থতাকেই গ্রহণ করো অসুস্থতার (ক্ষতিপূরণের) জন্য এবং জীবনকে গ্রহণ করো মৃত্যুর (পাথেয় সংগ্রহের) জন্য। সহিহ্ বোখারি : ১১/১৯০-২০০
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিনদের এমন কিছু বিষয় শিখিয়ে দিয়েছেন, যা তাদের দীর্ঘ আশার মরীচিকা থেকে রক্ষা করে এবং তাদের সামনে দুনিয়ার প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরে। তিনি আদেশ করেছেন মৃত্যুকে স্মরণ করার, কবর জিয়ারত করার, মৃতকে গোসল দেওয়ার, জানাজার সঙ্গে যাওয়ার, অসুস্থদের খোঁজ-খবর নেওয়ার ও নেককার মানুষের সান্নিধ্য গ্রহণ করার। কারণ এসব বিষয় মানুষকে সজাগ করে এবং অমোঘ ভবিষ্যতের প্রস্তুতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।