নিউজ ডেস্কঃ ইসলামী বিশ্বে সৌদি আরবের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা যে ক্রমাগত কমছে, সাম্প্রতিক আফগানিস্তান ইস্যুতে সেটি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯৮০ থেকে শুরু করে প্রায় দুই দশক আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য তাড়ানোর প্রক্রিয়ায় সম্মুখভাগে ছিল সৌদি। আফগান মুজাহিদীনদের অর্থ-সম্পদের অন্যতম প্রধান জোগানদাতাও ছিল তারা।
এরপর ১৯৯৬ সালে তালেবান বিদ্রোহীরা যখন কাবুলে সরকার গঠন করে, তখন যে তিনটি দেশ তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সৌদি আরব। তালেবানের সেই সরকারকে প্রথম দুই বছর অর্থকড়ির জোগানও দিয়েছে রিয়াদ। কিন্তু সেই তালেবানই যখন আবার ক্ষমতায়, তখন কাবুলে সৌদি দূতাবাস বন্ধ। রিয়াদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়সারা এক বিবৃতির বাইরে সৌদি সরকারের মুখ থেকে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আর কোনো কথা নেই।
এ প্রসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান সামি হামদী বিবিসি বাংলাকে বলেন, আফগান দৃশ্যপট থেকে সৌদি আরব উধাও। সারা বিশ্বে, এমনকি মুসলিম দুনিয়ায় সৌদি আরবের প্রভাব যে কমছে, এটি তারই নমুনা।
তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কাতার আফগানিস্তান ইস্যুতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। তারা কাবুল বিমানবন্দরকে সচল করছে, সৌদির একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গেও আফগানিস্তান নিয়ে কথা বলছে। এমনকি আরব আমিরাত অস্বস্তিতে পড়লেও চুপচাপ বসে নেই, আফগান পরিস্থিতি নিয়ে তারা কথা বলছে সৌদির প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের সঙ্গে। অথচ এ বিষয়ে সৌদি আরব কোথাও নেই।
সৌদিরাও যে এ নিয়ে হতাশ, তার প্রতিফলন দেখা গেছে দেশটির শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ওকাযের গত বুধবারের (১৫ সেপ্টেম্বর) সংস্করণে। জেদ্দা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রটির এক উপ-সম্পাদকীয়তে আফগানিস্তানে কাতারের ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ছোট ছোট দেশের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না যে, এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থরক্ষার ক্ষমতা রয়েছে শুধু সৌদি আরবের।
কাতার নিয়ে সৌদির মাথাব্যথা কেন?
প্রায় তিন বছর ধরে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে দরকষাকষি চলেছে, তাতে মধ্যস্থতা করেছে কাতার। তালেবান কাবুল দখলের পর বিদেশিদের আফগানিস্তান থেকে বের করার ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাতে বাইডেন প্রশাসন এতটাই সন্তুষ্ট যে, গত ৬ সেপ্টেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন একসঙ্গে দোহায় গিয়ে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে দেখা করেন। পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন, কাতার-যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্ক অভূতপূর্ব।
অথচ ২০১৭ সাল থেকে টানা সাড়ে তিন বছর এই কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছিল মার্কিন মিত্র সৌদি আরব।
সৌদি-তালেবান দূরত্ব
সম্পর্কে ভাঙনের শুরু মূলত ১৯৯৮ সালে। আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন সেসময় আফগানিস্তানে আশ্রয় নিলে তাকে আটক করে সৌদির হাতে তুলে দিতে বলে রিয়াদ প্রশাসন। তাতে গ্রাহ্য করেনি তৎকালীন তালেবান সরকার। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর তালেবান-সৌদি সম্পর্ক হিমঘরে চলে যায়।
২০০৮ সালে হঠাৎই বিভিন্ন মিডিয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ শুরুর খবর বেরোতে শুরু করে। সে বছর অক্টোবরে সৌদি সরকারের মালিকানাধীন দৈনিক আশরাক আল আসওয়াত জানায়, মক্কায় আফগান সরকারের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে তালেবানের কয়েকজন নেতার বৈঠক হয়েছে। তৎকালীন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল সাংবাদিকদের কাছে বৈঠকটির কথা স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের অনুরোধে সৌদি সরকার ওই বৈঠকের ব্যবস্থা করেছে।
আফগান সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিজামী জানান, মূলত বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর ২০০৮ সাল থেকেই গোপনে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয় এবং মক্কার বৈঠকটি ছিল তারই অংশ। নিউইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিডিয়ায়ও সেসময় গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে এ সম্পর্কিত খবর বের হয়।
ওই সময়টায়ই সৌদির সঙ্গে তালেবানের সম্পর্কে ফের চিড় ধরে। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় তালেবান রাজি না হয়ে তারা সায় দেয় কাতারের প্রস্তাবে।
নিজামী বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সঙ্গে সৌদির দহরম-মহরম দেখে ভরসা পায়নি তালেবান। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের কাতারকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সৌদি আরব পছন্দ করেনি।
বর্তমানে তালেবানের ওপর সৌদির কোনো প্রভাব নেই বললেই চলে। বিপরীতে গত কয়েক বছরে রিয়াদের চরম শত্রু ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে তালেবান।
সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি যে আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করবে, তা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি সৌদি সরকার। সে কারণেই হয়তো ২০১৯ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পাকিস্তান সফরের সময় তালেবানের একটি প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পাত্তা দেননি তিনি।
অবশ্য সে সময় বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরে দাবি করা হয়েছিল, তালেবান নেতারা নিজেদের ইচ্ছায় নয়, বরং পাকিস্তানের অনুরোধেই দোহা থেকে ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন।
আফগানদের সৌদিপ্রীতি
লন্ডনে গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইনস্টিটিটিউট ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষক উমর করিম অবশ্য মনে করেন, ইসলামের জন্ম যে দেশে, সেই সৌদি আরবকে অগ্রাহ্য করা তালেবানের মতো কট্টর সুন্নী একটি গোষ্ঠীর জন্য সহজ হবে না।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘তালেবানের জন্য সৌদি আরবের হাতে শক্ত একটি তুরুপের তাস রয়েছে- সেটি হচ্ছে ধর্ম। সৌদি যদি কোনোভাবে আফগানদের হজ ও ওমরাহ পালনে বাধা তৈরি করে, তাহলে সেটি তালেবানের জন্য বেশ ঝামেলার কারণ হতে পারে। তেমনটি হলে তালেবানের ইসলামী ভাবমূর্তি সাধারণ আফগান নাগরিকদের কাছে ভীষণভাবে মার খাবে।
সাইয়েদ নিজামীর বিশ্বাস, আফগানদের হজ বা ওমরাহ পালনে বাধা তৈরির মতো কোনো ঝুঁকি নেবে না সৌদি আরব। তিনি বলেন, আফগান জাতির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার পথ সৌদিরা কখনো নেবে বলে মনে করি না। সম্পর্ক অতিরিক্ত খারাপ হয়ে গেলে বড়জোর তালেবান নেতাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে।
কী করতে পারে সৌদি আরব
প্রশ্ন হচ্ছে, সৌদিরা তালেবানের ওপর তেমন কোনো চাপ তৈরি অথবা গোষ্ঠীটির সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের কোনো চেষ্টা আদৌ করবে কি না। সামি হামদী মনে করেন, তেমন কোনো ক্ষমতা বা ইচ্ছা এখন সৌদি আরবের নেই।
তিনি বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোহাম্মদ বিন সালমান চাপে রয়েছেন। খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষ্যাপা। তারপর ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা নিয়ে বেশকিছু গোপন নথি প্রকাশ্যে আসায় সৌদিরা আরও চাপে পড়েছে। ফলে সৌদি যুবরাজ এখন তাকিয়ে থাকবেন, বাইডেন তালেবানদের নিয়ে কী করেন, তা দেখতে। এটি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আফগানিস্তান বিষয়ে স্বাধীন কোনো নীতি নেওয়ার অবস্থায় এখন সৌদিরা নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা