নিউজ ডেস্কঃ সিনিয়র হিসেবে বড় ভাই না মানায় রাহাতকে শায়েস্তা করতে পরিকল্পনা করে সাদী। এজন্য তাকে ফলোও (অনুসরণ) করতে থাকে সে। ওই দিন রাহাতকে আঘাত করতে সাদী, তানভীর ও সানী কলেজের ফটকে যায়। এসময় কেউ আসছে কিনা তার খেয়াল রাখতে দায়িত্ব দেয়া হয় সানীকে। ছোরা দিয়ে আঘাত করার পরপরই তানভীর মোটরসাইকেলে করে দ্রুত সাদীকে জালালপুর বাজারে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে হাজিপুরে রাস্তার পাশের কাঁদা জমিতে ছোরাটি ফেলে যায় সাদী। এসময় রাহাত মারা গেছে জানার পরই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে সে। জালালপুর হয়ে চলে যায় শেরপুর। সেখানে মোবাইলে থাকা ১ হাজার ২০ টাকা ক্যাশ আউট করার পরে আল-মোবারকা গাড়ীতে করে চলে যায় রাজধানী ঢাকায়।
দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্র আরিফুল ইসলাম রাহাত হত্যাকান্ডের ব্যাপারে ঘাতক শামসুদ্দোহা সাদী (২৩) এভাবেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে সাদী এই হত্যাকান্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট (আমলি আদালত-২) মো. সুমন ভুইয়া গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। আদালতের উদ্ধৃতি দিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডি’র উপ-পরিদর্শক রিপন কুমার দেব সিলেটের ডাককে এই তথ্য জানিয়েছেন।
গতকাল বৃস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৫টায় মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট (আমলি আদালত-২) মো. সুমন ভুইয়া কলেজ ছাত্র আরিফুল ইসলাম রাহাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি শামসুদ্দোহা সাদীর জবানবন্দি রেকর্ড শুরু করেন। রাত পৌনে ৭টা পর্যন্ত টানা ২ ঘণ্টা জবানবন্দী দেয় সাদী। এরপর আদালতের নির্দেশে তাকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে সাদী বলেছে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে এক সময় রাহাতের সাথে ভর্তি হয়। বয়সে বড় হলেও রাহাত নাম ধরে ডাকতো সাদীকে। তেমন পাত্তাও দিচ্ছিল না। অনেক বলার পরও রাহাত বড় ভাই বা বয়সে সিনিয়র হিসেবে সাদীকে পাত্তা দেয়নি। এর ফলে সাদী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং রাহাতকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্যে পরিকল্পনা করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাহাতের উপর ছোরা দিয়ে হামলা করা হয়। কিন্তু, এই হামলায় রাহাত মারা যাবে তা তারা মনে করেনি। ঘটনার পর এক সাংবাদিকের কাছ থেকে প্রথমে রাহাতের মৃত্যুর খবর পায় সাদী। এরপর পালিয়ে ঢাকার মিরপুরে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করে। সেখান থেকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের চরাঞ্চলে আরেক আত্মীয়ের বাড়ীতে চলে যায়। এরপর সিআইডি তাকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে আসে সিআইডি। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাতে সাদীকে সিলেটে নিয়ে আসার পরই ছোরা উদ্ধারের জন্যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে দক্ষিণ সুরমার হাজিপুর এলাকার রাস্তার পার্শ্ব থেকে কাঁদা মাটি মাখা ছোরাটি উদ্ধার করে সিআইডি।
এদিকে, ছোরা উদ্ধারের পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় নগরের আগপাড়াস্থ (মিরাবাজার) সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করা হয়। সিআইডি সিলেট মেট্রো ও জেলার বিশেষ পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা এ সময় সাংবাদিকদের নিকট সাদী গ্রেফতার ও ছোরা উদ্ধারের ব্যাপারে ব্রিফিং করেন। তিনি বলেন, বাটসহ ৭ দশমিক ৫ ইঞ্চির ছোরা দিয়ে আঘাত করে ঘাতক সাদী। তার দেখানো অনুযায়ী, ছোরাটি উদ্ধার করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিদেরকে গ্রেফতারের জন্যে সিআইডি কাজ করছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চরাঞ্চল থেকে সাদীকে এলআইসি সিআইডি’র বিশেষ টিম গ্রেফতার করে। পরে তাকে রাজধানী ঢাকার মালিবাগে সিআইডি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়। বুধবার দুপুরে সিআইডি হেডকোয়ার্টারে বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর সাংবাদিক সম্মেলন করে গ্রেফতার অভিযানের তথ্য গণমাধ্যমে তুলে ধরেন। পরে তাকে সিআইডি’র সিলেটের কর্মকর্তাদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। মঙ্গলবার গ্রেফতারের দিন রাতেই রাহাত হত্যা মামলার তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত করে পুলিশ সদর দপ্তর। সিআইডি সিলেট কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক রিপন কুমার দেবকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
গত ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২ টায় দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজের গেইটের মাত্র ১০ গজ দূরে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম রাহাতকে (১৮) ছুরিকাঘাত করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত রাহাত দক্ষিণ সুরমার তেতলি ইউনিয়নের ধরাধরপুরের সৌদি প্রবাসী সুলাইমান মিয়ার একমাত্র পুত্র।
হত্যাকান্ডের পরদিন ২২ অক্টোবর শুক্রবার রাতে নিহতের চাচা শফিফুল ইসলাম বাদী হয়ে ৩ জনে নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫-৭ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। দক্ষিণসুরমা থানার মামলা নম্বর ২১, ধারা ৩০২/৩৪ দন্ডিবিধি। এজাহারে উল্লেখ করা আসামীরা হচ্ছে, মোগলাবাজার থানার সিলাম টিকর পাড়ার মোবারক হোসেনের পুত্র শামসুদ্দোহা সাদী, সিলাম পশ্চিম পাড়ার জামাল উদ্দিনের পুত্র তানভীর আহমদ ও দক্ষিণ সুরমার তেতলি ইউনিয়নের আহমদপুর গ্রামের মৃত গৌছ মিয়ার পুত্র ওলিদুর রহমান সানী।
দক্ষিণ সুরমা কলেজ প্রতিষ্ঠার ৩২ বছরের মধ্যে এটি প্রথম হত্যাকান্ড। এ ঘটনার পর কলেজের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা চন্ডিপুলে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন। ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ ৩ দিন পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করে। তাৎক্ষণিকভাবে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
গত রোববার দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন করে আমিনুল ইসলাম রাহাতের খুনীদের গ্রেফতার করতে আলটিমেটাম দেয় দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজ অধ্যক্ষ শামসুল ইসলাম খুনীদের গ্রেফতার না করলে আন্দোলনেরও হুমকি দেন। কলেজ কর্তৃপক্ষের এই আলটিমেটামের দু’দিন পর মূল ঘাতক সাদীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তবে, অন্য আসামিদের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।